ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
সাদামাটা এক ছাপাখানায় অবসরের পরও হাজার দুয়েক আয় হবে বলে কাজ করতো এক দাদু। বাড়ি ফেরার সময় ময়লা প্যান্টের পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে ছটা গুজিয়া কিনে আনতো নাতনির জন্য। বড়দিনে বালিশের নিচে রেখে দিত সুগন্ধি রবার, রঙ পেন্সিল, অনেক গুলো মন ভালো করে দেওয়া হজমিগুলি। নাতনি ঘুমোতে যাওয়ার আগে দিদার কাছে শুনতো সান্তা ক্লসের গল্প, রাজকন্যার গল্প, ঠাকুমার ঝুলির গল্প। মাথায় হাত বুলিয়ে দিত দিদা।
বছর দশেক পর, দিদার মারা যাওয়ার পর পরই দাদু মারা গেছিল। নাতনির সেদিন সেমিস্টার। যেতেই হত। শ্মশান থেকে ফিরে, দাদুর আলমারি খুলে এ জিনিস ও জিনিস ঘাঁটতে গিয়ে এক দিস্তে হলদে কাগজ বেরিয়ে এসেছিল। নাতনির করা হিজিবিজি, রঙ-পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুঁকি, অনেক বছরকার উপহার যেন।
পুজোয় কক্ষনো বাবার কিচ্ছু দরকার হত না। বাবার সব ছিল। দেখা যেত না যদিও বা। কাঁচভাঙা একটা মোবাইলে সেলোটেপ লাগানো, একাধিক সেলাই করা একটাই চামড়ার জুতো, কনফারেন্স এ পাওয়া কাঁধের ব্যাগ। সেই ব্যাগ থেকেই ছেলের জন্য একদিন বের করেছিল একটা ল্যাপটপ। উত্তেজিত ছেলে একবার ও জানতে চায়নি এলআইসির কাজ করে বাবা কিভাবে কিনলো ও জিনিস। বিশ্বাস করেছিল সান্টা আছে কোন এক দেশে। ঠিক চলে আসে এ সময়। দামী কিছু নিয়ে।
Santa Claus (Credit: Subharup Banerjee) |
মা কখনো চাকরি করেনি। তবু ও নানা রকম খেলনা কিনে দিত। স্কুল থেকে ফেরার পথে আইসক্রিম, বুড়ির চুল, আলো জ্বলা জুতো, ক্যাম্বিস বল, রহমানের ক্যাসেট। মা কি সান্টা হয় নাকি বোকা।
দাদাভাই তো দিনভর আমার সাথে ঝগড়া করতো। একদিন খুব কাঁদছিলাম সন্ধেবেলা পাড়ার মাঠ থেকে ফিরে। আসলে ভোম্বল কিছুতেই ব্যাটিং দেবে না বলেছিল সেদিন। ও রোজ ব্যাট আনতো। আমায় তো বল কেনার টাকাও দিত না বাবা। আমি লজ্জায়, অপমানে একটানা ফিল্ডিং করেছিলাম। দাদা সবটা দেখেছিল। বড়দিনে কে যেন একটা ক্রিকেট ব্যাট উপহার দিয়েছিল আমায়। এরপর আর কোনদিন দাদার সাইকেলটা চোখে পরেনি। বাবাকে বলেছিল চুরি হয়ে গেছে। থাপ্পড় ও খেয়েছিল খুব। মুচকি হেসেছিল স্রেফ ভোম্বলের সামনে দিয়ে আমাকে নতুন ব্যাট হাতে মাঠে যেতে দেখে।
বোন বরাবর খুব চুপচাপ। বন্ধু ও ছিল না সেরকম। খালি পড়াশোনা করতো আর দাদাকে দেখতো আড্ডা মারছে, গান লিখছে, প্রেম করছে। মাধ্যমিকে বোন প্রথম হয়েছিল। দাদা তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, একটা সেমিস্টারে ফেল করেছে, স্যার 'গাঁজাখোর' বলে, বাকিরা বলে 'Loser'। মাধ্যমিকের রেজাল্ট এর দিন, টিভিতে বোনের ইন্টারভিউ দেখছিল দাদা। বোনকে সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল, তোমার আইডল কে? মেয়েটা চকচকে চোখে বলেছিল, দাদা। আমার আইডল আমার দাদা। টিভির ওপারে লুজার ঘরে বসে ঝমঝম করে কাঁদছে।
ছবিঃ রাজীব সিং |
সান্তা ক্লস আমাদের চার দেওয়ালেই আছে। পাজামা পরে, নোংরা শাল জড়িয়ে, হলুদ মাখা আঁচলে, সিঁদুর, সোহাগ এ। ওদের বড়দিন লাগেনা মন ভালো করতে। কেক লাগেনা, ঘন্টা লাগেনা, লাল টুপি, স্লেজ গাড়ি, Elf লাগেনা। এরা রোজ নিজের সন্তানদের একটা দিনবদলের গল্প বলে, একটা সুন্দর সকাল উপহার দেয়, ফেলে আসা দারিদ্র্য ঢেকে দেয় রকমারি বেলুন, লজেন্স, রামধনুতে।
আমাদের মা, বাবা, দাদু, দিদা, দাদাভাই, বোন কেউ প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, হামাস, আইসিস, মানববোমা, যুদ্ধ জাহাজ, আংকেল স্যাম এর গল্প বলে না। বাবা মায়ের ধর্ম আধপেটা খেয়ে মোজা ঝুলিয়ে রাখা, উপহার দিয়ে যাওয়া সান্টার নাম করে, একটা ঝলমলে সকাল উপহার দেওয়া সন্তানকে।
Image Credit: Subhajit Das |
পৃথিবীর সব মৃত বাবা মা ই চেয়েছিল সন্তানের কপালে চুমু খেয়ে যেতে। সান্টা ক্লস সাজতে, বন্দুক, আফিম, ড্রাগস এর বদলে কেক, পেস্ট্রি রেখে যেতে।
আসুন রোজকার জীবনের এই সিক্রেট সান্টা ক্লস, ওই সুপার হিরোদের ভালোবাসি, ভালো করে দুটো কথা বলি। কাজ না হয় পরে হবে, চাকরি ও হবে। দু চার কথা বলি, মাথায় হাত বুলিয়ে দিক সান্টা। উষ্ণতা আসুক।
©️ ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
0 Comments