আজ অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরে-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের ১৪৭তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর এ. কে. ফজলুক হক ওপার বাংলার বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ ও সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র সন্তান।
বাড়িতেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষালাভ করেন। ১৮৮১ সালে তিনি বরিশাল জেলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণে ফজলুল হক শিক্ষকদের খুবই স্নেহভাজন ছিলেন। তিনি ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যাপনা করতেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়েরও স্নেহভাজন ছিলেন। এফ.এ. পাশ করার পর তিনি ১৮৯৩ সালে তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় অনার্সসহ প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. পাশ করেন। বি.এ. পাশ করার পর ইংরেজিতে এম.এ. ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাঁকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, "মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়"। এই কথা শুনে এ. কে. ফজলুক হক জেদ করে অঙ্কশাস্ত্রেই পরীক্ষা দেন এবং মাত্র ছয় মাস অঙ্ক পড়েই তিনি প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তিনি ১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল. পাশ করেন। এরপর স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবীশ হিসাবে কলকাতা হাইকোর্টে কাজ শুরু করেন। ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিষ্ঠান করেছেন তার মধ্যে বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী (১৯২৪), কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭ - ১৯৪৩) উল্লেখযোগ্য।
ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাংলার নিপীড়িত দরিদ্র কৃষকদের নায্য অধিকারকে মান্যতা দিয়ে তিনি অবিভক্ত বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করে বাংলার রাজনীতিতে কৃষকদের অধিকারকে প্রাসঙ্গিক করে তোলেন। তিনি বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে 'ফ্লাউড কমিশন' গঠন করে। ১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনী পাস করানো হয় এবং কৃষকদের উপর জমিদারদের লাগামহীন অত্যাচার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়। পাটচাষীদের নায্য মূল্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে 'পাট অধ্যাদেশ' জারি করা হয় ১৯৩৮ সালে। ১৯৩৯ সালে 'চাষী খাতক আইন' এর সংশোধনী এনে ঋণ সালিশি বোর্ডকে শক্তিশালী করা হয়। ক্লাউড কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ১৯৪০ সালে হক সাহেব আইন পরিষদে 'মহাজনী আইন' পাস করান। এ বছরই 'দোকান কর্মচারী আইন' প্রণয়ন করে তিনি দোকান শ্রমিকদের সপ্তাহে একদিন ছুটি ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের নির্দেশ বলবৎ করেন।
তাঁর আমলেই দরিদ্র কৃষকের উপরে কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি পরিষদের সভায় মোট ১৪৮ বার বক্তৃতা করেন। এর মধ্যে ১২৮ বার তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষা সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। তাঁর উদ্যোগেই ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারমাইকেল ও টেইলার হস্টেল স্থাপন করা হয়েছিল। তৎকালীন শিক্ষা বিভাগের ডিপিআই হর্নেল সাহেব ফজলুল হকের শিক্ষাবিষয়ক উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তাঁকে বাংলার ‘বেন্থাম’ হিসেবে সম্মানিত করেন। কিশোর কিশোরীদের জন্য তিনি নিজের সম্পাদনায় “বালক” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং “ভারত সুহৃদ” নামে যুগ্ম সম্পাদনায় আরও একটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত নবযুগ নামক পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করানো হয় এ. কে. ফজলুল হককে দিয়ে কিন্তু পরবর্তীতে তিনি সেই প্রস্তাব থেকে সরে আসেন।
১৯৪৬ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন। কিন্তু, দলীয়ভাবে পরাজিত হলে মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা গঠন করেন ও বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই নির্বাচনের পর দলীয় নেতাকর্মীদের চাপে হক সাহেব মুসলিম লীগে যোগ দিতে বাধ্য হন। কিন্তু দলের সদস্য হিসেবে তিনি নীরব ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল এ কে ফজলুক হক ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
আজ এই মহান বাঙালি নেতাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দরিদ্র কৃষকদের অধিকারের জন্য তাঁর লড়াই ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান আজকের প্রজন্ম ভুলতে বসেছে। তাই এপার বাংলাই শেরে বাংলার জন্মবার্ষিকী পালন করার মধ্যে দিয়েই ওনার অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ও নিপীড়িত মানুষদের জন্য অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের গাথা প্রচার এখন সময়ের দাবি।
0 Comments