সংকলন: রামিজ রাজা
সমস্ত মানবজাতির মধ্যে সত্য ভাতৃভাব জাগাইতে হইলে ভিন্ন ভিন্ন জাতিসমূহকে বিকশিত করিতে হইবে। তাহার পূর্ব্বে এই ভাতৃভাব অসার কল্পনা মাত্র। জাতি তুলিয়া দিলে বিশ্বমানব দাঁড়াইবে কোথায়? যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির বিকাশ না হইলে একটি পরিবারের উন্নতি হয় না, যেমন পরিবার সমূহের উন্নতি না হইলে সমাজের উন্নতি হয় না, যেমন সমাজের উন্নতি না হইলে জাতির উন্নতি হয় না, ঠিক তেমনি সেই একই কারণে সকল ভিন্ন ভিন্ন বিশিষ্ট জাতির উন্নতি না হইলে সমগ্র মানবজাতির উন্নতি হয় না। এই ভাবনা যিনি সকলের মধ্যে জারিত করতে পেরেছিলেন তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। আজ তাঁকেই স্মরণ করছি আমরা। এই মহামানবের আজ জন্মদিন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যখন হিন্দু মুসলিম নিয়েই ব্যস্ত, তখন বাঙালির পরিচয় কেমন হওয়া উচিত তাইই তুলে ধরা হয়েছে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের লেখা থেকেই সংকলন করা হল দু'চার কথা।
তিনি বলেছিলেন, বাঙালির শিরায় শিরায় যে রক্তই প্রবাহিত হউক না কেন, সে রক্ত আর্য্যই, কি অনার্য্যই হউক, কি আর্য্য অনার্য্যের মিশ্রিত রক্তই হউক, বাঙালি যে বাঙালিই সে কথা আর ত সে ভুলিতে পারে না। সে যে বাংলার মাটি বাংলার জলে বাড়িয়া উঠিয়াছে, বাংলার মাটি বাংলার জলের সঙ্গে নিত্যই যে তাহার আদান-প্রদান চলিতেছে। আর সেই আদান-প্রদানের মধ্যে যে একটা নিত্য সত্য জাগ্রত সম্বন্ধের সৃষ্টি হইয়াছে, সেই সম্বন্ধের উপর বাংলার জাতিত্বের প্রতিষ্ঠা।
বুঝিলাম, বাঙালি হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, খৃস্টান হউক, বাঙালি বাঙালি। বাঙালির একটা বিশিষ্ট রূপ আছে, একটা বিশিষ্ট প্রকৃতি আছে, একটা স্বতন্ত্র ধর্ম্ম আছে। এই জগতের মাঝে বাঙালির একটা স্থান আছে, অধিকার আছে, কর্তব্য আছে। বুঝিলাম, বাঙালিকে প্রকৃত বাঙালি হইতে হবে। বিশ্ববিধাতার যে অনন্ত বিচিত্র সৃষ্টি, বাঙালি সেই সৃষ্টি স্রোতের মধ্যে এক বিশিষ্ট সৃষ্টি। অনন্তরূপ লীলাধারের রূপবৈচিত্র্যে বাঙালি একটি বিশিষ্টরূপ হইয়া ফুটিয়াছে। আমার বাংলা সেই রূপের মুর্ত্তি; আমার বাংলা সেই বিশিষ্টরূপের প্রাণ। যখন জাগিলাম, তা আমার আপন গৌরবে তাঁহার বিশ্বরূপ দেখাইয়া দিলেন। সে রূপে প্রাণ ডুবিয়া গেল। দেখিলাম, সে রূপ বিশিষ্ট, সে অনন্ত! তোমরা হিসাব করিতে হয় কর, তর্ক করিতে চাও কর - আমি সে রূপের বালাই লইয়া মরি।
জাতিত্বের গুণেই এক জাতি দান করিতেও সক্ষম হয়, গ্রহণ করিতেও সক্ষম হয়। ইহা সেই জাতির অবস্থার বিষয়, স্বভাবের বিষয়। তার পর বিরোধের কথা, জাতিত্বের প্রভাবে যে কতকটা বিরোধ জাগিয়া ওঠে, তাহা অস্বীকার করা চলে না। সেও জাতির স্বভাবের ধর্ম, তা বলিয়াই জাতিগুলোকে উড়াইয়া দেওয়া যায় না। প্রত্যেক পরিবারমধ্যে প্রত্যেক সমাজে বিরোধ বিসংবাদ তো লাগিয়াই আছে, তা বলিয়াই কি সেই ব্যক্তিগুলার অস্তিত্ব অস্বীকার করিতে হইবে, না উড়াইয়া দিতে হইবে? শত প্রকারের বিরোধ-বাদ-বিসংবাদের মধ্যেই মানুষ মানুষ হইয়া ওঠে ও মিলনের পথ খুঁজিয়া পায়। এই যে সব বিশিষ্ট জাতিসমূহ, ইহাদের পক্ষে ঐ একই কথা খাটে। এই বিরোধ-বিসংবাদ সংঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেই এই সব বিশিষ্ট জাতি সমস্ত মানবজাতির যে যে মিলন-মন্দির, সেইদিকে অগ্রসর হইতেছে ও হইবে।
যাহা চিরকাল আছে, তাহাকে দেখিতে পাই নাই, বুঝিতে পারি নাই বলিয়া কি ধরিয়া লইতে হইবে যে, তাহার কোন অস্তিত্ব ছিল না? মাধ্যাকর্ষণ যেমন নিউটন জন্মাইবার আগেও ছিল, আমাদের জাতির অস্তিত্ব তেমন ইংরাজ আসিবার আগেও ছিল। আমরা দেখিতে পাই নাই বলিয়া যে তাহা ছিল না তাহা নহে। আমাদের নবজাগ্রত বাঙালি জাতির যে জাতিত্ব, তাহা আমাদের প্রাণবন্ত, বিদেশের নহে।
এখন আমাদের বিচার্য্য যে, কেমন করিয়া এই নব জাগ্রত বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত করিয়া তুলিতে পারি। সেই কারনে সেই দিক দিয়াই দেখিতে হইবে, আমাদের বিকাশের জন্য কি কি আবশ্যক এবং তাহা কি করিয়া পাইতে পারি।
(দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাঙ্গলার কথা থেকে রামিজ রাজার সংকলন)
0 Comments