আসিফ রেজা আনসারী
ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন বিজেপির নেতা-নেত্রী নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দাল। এই প্রথম অবশ্য তার ওপর আক্রমণ হচ্ছে এমনটা নয়। বিশ্বজুড়ে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে এমন কুরুচিকর মন্ত্যব্য করা হচ্ছে। একইসঙ্গে মুসলিম বিদ্বেষের ঘনঘটা সর্বত্রই বিরাজমান। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানার কারণে মুসলিম জনমানসে তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মানুষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। কোথাও কোথাও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন। এই বিক্ষোভ-অবরোধ কিংবা প্রতিবাদের নামে রাস্তায় নেমে আসা একেবারেই যে ঠেকানো যাবে, সে কথা কেউই জোর করে বলতে পারেন না। তবে এ কথা বলা যেতেই পারে নবীর আদর্শ ও জীবন-ব্যবস্থা যা তিনি প্রবর্তন করেছিলেন তাকে সঠিকভাবে মেনে চলছেন না মুসলিম সমাজ।
হযরত মুহাম্মদ সা. তৎকালীন আরবের সমাজ ব্যবস্থায় বিপ্লব এনেছিলেন। শুধু তাই নয় গোটা বিশ্বেই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি নবজোয়ার এনেছিলেন। সামাজিক বিপ্লব ঘটেছিল। একসময় মার্কসীয় দর্শন যেভাবে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করে, তেমনি মুহাম্মদের প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক রণকৌশল, নয়া সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের শক্তির দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিল বিশ্ব-রাজনীতি। চৌদ্দশো বছর পরেও মুহাম্মদের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনৈতিক রণকৌশল এবং কূটনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বাস্তব প্রয়োগ সমানভাবে প্রযোজ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। মুহাম্মদ সম্পর্কে একটা বৃহৎ অংশের মানুষের অজ্ঞানতা, অপ্রতুল জ্ঞান অন্ধ বিশ্বাস ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে। আসলে না জানা ও ভুল জানা, দুটোই ক্ষতিকর। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছেন কেউ কেউ। তাই বিভেদকামীদের এই বিদ্বেষ প্রচার ও অপকৌশলকে রুখতে হলে মুসলিমদেরকে সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে।
কিন্তু কিভাবে?
মুহাম্মদ সা.-এর জীবন ও আদর্শ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন এবং বাস্তবিক জীবনে তার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা ইসলামের সঠিক শিক্ষাকে তুলে ধরতে পারে। যা বর্তমান সমাজে মুসলিমদের সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নেই, আছে কিছু উগ্রতা এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াজনিত আলটপকা কর্মকাণ্ডের লোকজন। তারা বিভিন্ন জায়গায় অশান্তি সৃষ্টি করছে অথচ গান্ধিগিরি করে, মুহাম্মদের পথ অবলম্বন করে এগুলোর জবাব দেওয়া যেত। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ্ অশান্তি সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। তারপরেও প্রতিবাদের নামে রাস্তা অবরোধ করে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেওয়ার এই ভুল সিদ্ধান্ত কিভাবে মেনে নিচ্ছেন মুসলিমরা? তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা দরকার।
হযরত মুহাম্মদ যখন ধর্মপ্রচার করছেন আরবের তায়েফ নামক এক জায়গায় তাকে প্রচুর অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রতিশোধ না নিয়ে, অভিসম্পাত না করেই সেখানকার মানুষকে ক্ষমা করেছিলেন। ক্ষমা মুহাম্মদ সা.-এর জীবনী একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একান্তই অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, অত্যাচারকে রুখে দেওয়ার জন্য অস্ত্রধারণ যখন আবশ্যক হয়ে পড়েছে, তখনই যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন মুহাম্মদ সা.। অন্যথা শান্তিচুক্তি, ধৈর্যধারণ এবং ক্ষমা ছিল তার জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম।
মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে প্রখ্যাত লেখক কে এস রামাকৃষ্ণ রাও লিখছেন_"পয়গম্বর মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগমনের ঊষালগ্নে আরব একটা ধূ-ধূ মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাঁর অমিত আধ্যাত্মিকতার বলে এই প্রাণহীন ঊষর মরুভূমি পরিণত হল এক নতুন পৃথিবীতে—জন্ম হল এক নতুন জীবনের, এক নতুন সংস্কৃতির, এক অভিনব সভ্যতার ও এক সুপরিপক্ক রাষ্ট্র ব্যবস্থার। এই সুবিশাল সমাজ-সভ্যতা কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থা ধীরে ধীরে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল মরক্কো থেকে সিন্ধু নদী পর্যন্ত এবং যার অত্যাশ্চর্য প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মতো তিনটি মহাদেশের প্রত্যন্ত জনপদে। এইভাবে ইসলাম এই তিনটি জনবহুল মহাদেশের অগণিত জনগণের চিন্তা ও ভাবধারাকে প্লাবিত করেছিল।"
হযরত মুহাম্মদ সা.-এর জীবন ও সাধনা ছিল অন্যমাত্রার। নবীকে ভালবাসতে হলে সেই পথকে অবলম্বন করতে হয়। কোনও ব্যক্তির আদর্শকে না মেনে মুখে ভালবাসি বলার নাম কখনোই ভালোবাসা বা শ্রদ্ধার হতে পারে না। নবীর জীবন অনেক অনেক দামি, উচ্চমার্গের। সে পথ অবলম্বন না করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যাওয়া বড় ভয়ঙ্কর পরিণতির জায়গা তৈরি করে। ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে দেখতে হলে বিভেদকামী শক্তি যারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী, তাদেরকে জায়গা করে দিতে রাজ্যের কয়েক জায়গায় যেভাবে বিক্ষোভ হচ্ছে সেগুলোই যথেষ্ট। নবীকে ভালবাসতে হলে শিখতে হয় তিতিক্ষা, ভালোবাসা, সাধনা ও জীবনচর্যা।
এ কথা ভুলে গেলে হবে না মক্কা বিজয়ের পর ১ মিলিয়ন বর্গমাইল জমি মুহাম্মদের পদতলে এসেছিল। অথচ তিনি নিজে জুতোসেলাই করতেন, তালি দেওয়া পোশাক পরতেন, নিজের ঘর নিজে পরিষ্কার করতেন, গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে স্ত্রীদের সঙ্গে হাতে হাত মেলাতেন। তিনি ইচ্ছে করলে প্রচুর অর্থ ও সম্পদে সমৃদ্ধ হতে পারতেন, অথচ মুহাম্মদ সা. বেছে নিয়েছিলেন সাধারণের জীবন। সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পর তার ছিল না কোনও নরম বিছানা কিংবা সিংহাসন। খেজুর পাতার বিছানাতেই ঘুমোতো মুহাম্মদ সা.। অধিক সময় ঈশ্বরের প্রার্থনা ও ইবাদতের কাটিয়ে দিতেন। স্রষ্টার দরবারে কেঁদে বুক ভাসায়ি প্রার্থনা করতেন, হে প্রভু আমাকে দায়িত্ব পালনের শক্তি দাও।
হযরত মুহাম্মদ সা. যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন সেদিন তার ঘরে ছিল সামান্য কিছু মুদ্রা যার একটি অংশ দিয়ে ঋণশোধ করা হয়েছিল, বাকি অংশ দান করা হয়েছে এক গরীবকে যিনি তাঁর ঘরে সাহায্য পাওয়ার জন্য এসেছিলেন। ঘর থেকে সারা বিশ্বকে আলোয় আলোকিত করেছেন মুহাম্মাদ সা. তার মৃত্যুর পর সেই ঘরে অন্ধকার নেমে আসে, কারণ প্রদীপ জ্বালানোর মত তেল ছিল না। এমন জীবন-সাধনার সাধক ছিলেন মুহাম্মদ সা.। যে সাধনা মানুষকে শেখায় ভালোবাসা, মানুষকে শেখায় ত্যাগ-তিতিক্ষা যা গ্রহণ করেনি মুসলিম সম্প্রদায়। তাই লাঞ্ছনা-বঞ্চনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর থেকে উত্তরনের একটাই উপায় শিক্ষা ও সাধনা। মুহাম্মদের জীবনচর্চাকে জীবনের অংগীভূত করা, মুসলিমদের উচিত নিজেদেরকে অভিযোজিত করা।
[লেখক পেশায় সাংবাদিক, আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে স্বাধীন গবেষক।]
0 Comments