২০০৪–২০২৪, বাজপেয়ী থেকে মোদি

মুদাসসির নিয়াজ 

২০০৪ আর ২০২৪। মাঝে দুই দশকের ব্যবধান।২০০৪-এ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অটল বিহারী বাজপেয়ী। প্রথমে ১৯৯৬ সালে ১৩দিন, তারপর ১৯৯৮-৯৯ সালে ১৩ মাস, সবশেষে ১৯৯৯-২০০৪ অর্থাৎ ৫ বছরের পূর্ণ মেয়াদ। আর এখন কেন্দ্র সরকারের রথী-মহারথী ও সারথীরা বলছেন ৫০ বছর তারা নাকি ক্ষমতায় থাকবেন। কোই মাই কা লাল নেহি যে, ওদেরকে সরাবে। ওদের দৃষ্টিতে রাহুল তো পাপ্পু। তাই এবার নাকি ওরা কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়বেন। 

বাজপেয়ী সরকারের শেষের দিকে(২০০৪)স্লোগান ছিল "শাইনিং ইন্ডিয়া"।আর এখন কাল কা যোগীর দল আমদানি করেছে "অমৃতকাল" স্লোগান।আচ্ছে দিনের গল্প কবেই আঁতুড়ঘরে আত্মহত্যা করেছে। এখন আর 'আচ্ছে দিন' নিয়ে কেউ চায়ে পে চর্চা করে না।সরকার বাহাদুরও আচ্ছে দিন নিয়ে মন কী বাত করে না। আচ্ছে দিনের ফেরিওয়ালার বিলম্বে হলেও বোধোদয় হয়েছে। এখন তিনি বুঝেছেন আচ্ছে দিন নয়, আসছে দিন, যাচ্ছে দিন, ভোট এলেই পাকিস্তান-চিন, তাতেই সব নাচবে তা ধিন ধিন। 

২০২৪ খুব বেশি দূরে নয়। পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের বাকি মাত্র ১৬-১৭ মাস। এবারও মোদিজী জিতলে হ্যাট্রিক করবেন। ২০২৪ সাল হবে অমৃতকাল। এটা সত্যি হলে বিজেপি ও মোদি-শাহদের ষোলকলা পূর্ণ হবে। যাই হোক, গত ২০ বছরে ভারত অনেক পাল্টেছে। পাল্টেছে রাজনীতি থেকে রাজনৈতিক সমীকরণ ও মেরুকরণ। পাল্টেছে নেতানেত্রী। পাল্টেছে জনতা। পাল্টেছে আম আদমির মন, মেজাজ, মনোভাব। পাল্টেছে বাজপেয়ী-আদবানী যুগলবন্দি। তার বদলে এখন এসেছে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুড়িদার।


২০০৪ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে বাজপেয়ি সরকারের প্রধান প্রচার ছিল, ভারত অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়েছে। অর্থাৎ শাইনিং ইন্ডিয়া। ২০০৪ সালে বিজেপির সামনে সেই অর্থে কোনও বিপক্ষ ছিল না। রাহুল গান্ধী তখন রাজনীতির বাইরে বিদেশে পড়াশোনা করছেন। সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস কিংবা বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দলের শক্তিশালী জোট কিছুই সেরকম প্রভাবশালী ছিল না। অতএব ধরে নেওয়া হয়েছিল ড্যাংডেঙিয়ে ফের জিতবেন বাজপেয়ি। স্বাধীনত্তোর ভারতে ২০০৪ সালের নির্বাচনী ফলাফল ছিল রহস্যময়। সেবার বাজপেয়ির এনডিএ জোট যে ওভাবে পরাস্ত হবে, তা ছিল অকল্পনীয়। ২০২৪ যদি ২০০৪ এর জেরক্স কপি হয়, সেটা মাথায় রাখতে হবে মোদি-শাহ জুটিকে। ইতিহাস কিন্তু ঘুরে ফিরে আসে, পুনরাবৃত্ত হয়। ২০০৪ এর ইতিহাস থেকে মোদিকে শিক্ষা নিতে হবে। 

২০০৪ এর বাজপেয়ীর মতোই মোদিও নিজেকে একরকম অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলেই মনে করছেন। আবার দু-দশক আগের মতোই বিরোধী শিবিরও এখন আপাতদৃষ্টিতে ছন্নছাড়া বলেই মনে হচ্ছে। অর্থাৎ ২০ বছর আগের চিত্রনাট্য অনেকখানি মিলে যাচ্ছে। কিন্তু ভোট তো দেবে জনগণ। মোদিজী সেই ভোটদাতা জনগণকে কেবলই নিজের মন কী বাত শুনিয়ে চলেছেন। আর কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পদব্রজে রাহুল গান্ধী জনগণের মন কী বাত শুনছেন। এই শোনানো আর শোনার মধ্যে যদি বিরাট ব্যবধান থেকে থাকে, তাহলে ২০২৪ এ ঘটে যাবে মিরাকল। সেই দেওয়াল লিখন হল জনগণের পালস। সিএএ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড কিংবা হিন্দু রাষ্ট্রের বুলি আউড়ে গত ৮ বছরের ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। 

২০২৪ সাল এখনও আসেনি। কিন্তু মোদি-শাহদের নেতৃত্বে বিজেপি যে পথে চলছে তাতে করে তারা কেবল শাইনিং নয়, হাইভোল্টেজ ইন্ডিয়াকে তুলে ধরতে চাইছে। এরা বাজপেয়ীর মতো ডজন খানেক দলকে নিয়ে জোট সরকার চালাচ্ছে না, চালাতে পারবেও না। নাম কা ওয়াস্তে "এনডিএ" বলা হলেও এই জোটে সবেধন নীলমনি একাই কুম্ভ রক্ষা করছে বিজেপি। তাই এই সরকারকে কেউ এনডিএ বলে ডাকে না, সবাই বলে মোদি সরকার। বহুদলীয় গণতন্ত্র বা জোট রাজনীতির অস্তিত্ব খতম করে এদের টার্গেট হল এক দেশ এক দল এক সরকার প্রতিষ্ঠা। সেটা কবে ও কতদূর সম্ভব কিংবা আদৌ সম্ভব কিনা, সে উত্তর সময়ই দেবে। কিন্তু তার থেকেও  বড় ভাবনা হল, ২০২৪ এ মোদি হেরে গেলে, নতুন সরকার এলে কী হবে? ২০২৯ সালে কি মোদি পুনরায় নির্বাচনী ময়দানে নামবেন? অথবা সেই সময় তাঁর শারীরিক সক্ষমতা এতখানি থাকবে কি? বয়সকে তো অস্বীকার করা যায় না। যদি তাই হয়, তাহলে বিজেপির জন্য আরও বিপদ ঘনিয়ে আসবে। কারণ, দল এবং সংঘ পরিবারকে পিছনে ফেলে মোদি নিজেকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন, সেখান থেকে নতুন কোন প্রধানমন্ত্রীর মুখ কি দেখাতে পারবে বিজেপি। ২০২৪ এ বিজেপি পরাজিত হলে কিন্তু হিন্দুত্বের পোস্টারবয় সেজে থাকা যোগী আদিত্যনাথ কিংবা হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে ২০২৯ এ প্রোজেক্ট করা সম্ভবপর হবে না। তখন বাজপেয়ীর মতো নরমপন্থী নেতাকে সামনে তুলে আনতে হবে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? তবে রাজনীতিকে যদিও সম্ভবনাময় শিল্প বলা হয়। মোদি-শাহরা কিন্তু তাঁদের উত্তরসূরী তৈরি করে যাচ্ছেন না। তারওপর এই জুটি আবার বিজেপি এবং আরএসএস-কে সেভাবে পাত্তা দেন না বা তোয়াক্কা করেন না। তাঁরা দিল্লির গদিতে বসে গুজরাতি ঘরানায় নিজেদের মতো করে দল ও সরকার চালাচ্ছেন। যার ফলে দলের অন্দরেই এই দুই সুপার পাওয়ারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। গত ৮ বছর ধরে সেই ক্ষোভ ও রোষ ছাইচাপা আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছে। তারা একটু সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন। সত্য কথা বলতে গেলে – বিজেপি ও তার অভিভাবক আরএসএস এর মন কী বাত হল, মোদি-শাহ আপদ বিদায় হোক। এরা দুজনে এত বেশি মাতব্বরী ও দাদাগিরি চালাচ্ছে যে, কানপুর ও নাগপুরের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ, এই দুজন বিজেপি-আরএসএস এর শিকড় কেটে শিখরে জল দিচ্ছে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব। আপনারও বক্তব্য থাকতে পারে, লিখে পাঠান আমাদের। বেঙ্গল মিরর সবার মতামতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে। –সম্পাদক, বেঙ্গল মিরর)

Post a Comment

0 Comments