নাসরিন নাজমা
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর"
কবির এই লাইন দুটি সত্যিই কি আমরা সভ্যতার সারসত্য বলে আত্মস্থ করেছি কোনোদিনও! হয়তো হ্যাঁ, অথবা না।তাই হয়তো কখনও,পৃথিবীর কোথাও শুধু মেয়ে হওয়ার অপরাধে গুমরে মরে কেউ।
আবার এই পৃথিবীরই অন্য কোনও
কোণে ছেলে হওয়ার সামাজিক দায় বইতে না পেরে মৃত্যুকে আপন করেছে কেউ।
লিঙ্গ–বৈষম্যকে মুছে দিতে, সাম্যতার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে গার্ল চাইল্ড–ডে ,উইমেন্স–ডে মতোই প্রতিবছর ১৯
নভেম্বর পালিত হয়ে আসছে ইন্টারন্যাশনাল মেন'স ডে বা আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস।পুরুষ দিবসের এই উদযাপন আজ হঠাৎ করে শুরু হয়নি
বরং এর ইতিহাস বেশ লম্বা।
১৯২২ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে পালন করা হতো 'রেড আর্মি এন্ড নেভি ডে'।
মূলত পুরুষদের বীরত্ব আর ত্যাগকে সম্মান জানাতেই পালিত হতো উৎসব।পরবর্তীতে ষাটের দশকে পুরুষ দিবস পালনের জন্য লেখালেখি শুরু হয়।১৯৬৮ সালে আমেরিকান সাংবাদিক জন পি হ্যারিস তাঁর লেখায় পুরুষ দিবস পালনের গুরুত্ব তুলে ধরেন।এরপর ১৯৯২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি থমাস ওষ্টার শুরু করেন পুরুষ দিবসের উদযাপন যা ছিল নারী দিবসের পাল্টা সংস্করণ।তারও কয়েকবছর পরে ১৯৯৯ সালে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে জেরম তিলকসিং এর উদ্যোগে ১৯শে নভেম্বরকে বেছে হয় আন্তজাতিক পুরুষ দিবস হিসেবে।
পুরুষ দিবস উদযাপন শুধুমাত্র নারীদিবসের এক পাল্টা অনুকরণ নয়।
বরং এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু উদ্দেশ্য।
যেমন:-পুরুষ ও বালকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি;
-নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ক প্রচারণা;
-নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক সাম্যতার প্রচার;
পুরুষদের মধ্যে ইতিবাচক আদর্শ চরিত্রের গুরুত্ব তুলে ধরা;
-পুরুষ ও বালকদের নিয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংস্কার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরী;
-পুরুষ ও বালকদের অর্জন ও অবদানকে উদ্যাপন;
-সমাজ, পরিবার, বিবাহ ও শিশু যত্নের ক্ষেত্রে পুরুষ ও বালকদের অবদানকে তুলে ধরা।
প্রতিবছর একটি বিশেষ থিমকে তুলে ধরা হয় সমাজের বিভেদ রেখা নিরসনের লক্ষ্যে।যেমন এ বছরের থিম হলো "হেল্পিং মেন এন্ড বয়েস"।পুরুষ এবং বালক-কিশোরদের সাহায্য করা।কিন্তু কেন পুরুষদের সাহায্য প্রয়োজন?ঠিক কী কী অসুবিধের মুখোমুখি হতে হয় পুরুষদের?
লিঙ্গ বৈষম্য শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত।নারী বৈষম্য ,সমাজে নারীর প্রতি হয়ে চলা বৈষম্যমূলক আচরণ এবং মেয়েদের ভোগান্তির কথাও আজ অনেকেই জানেন।এমনকি পুরুষের অত্যাচারে নারীর আত্মহত্যার খবরও পাওয়া যায় আকছার।কিন্তু পুরুষরাও যে বৈষম্যের স্বীকার ,মানসিকভাবে ,সামাজিকভাবে এমনকি শারীরিক দিক থেকেও অত্যাচারের স্বীকার হন ,হচ্ছেন বহু ক্ষেত্রেই সে খবর কজন রাখেন!বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৩০% পুরুষ বিভিন্নভাবে নারীদের অত্যাচারে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন এ খবর অনেকের কাছেই অজানা এবং বিস্ময়কর।
পারিবারিক জীবন:
ভারত ,বাংলাদেশ সহ বেশিরভাগ পুরুষতান্ত্রিক দেশেই পারিবারিক জীবনে মেয়ে বাচ্চার তুলনায় ছেলে বাচ্চার প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয় বেশি।একটি ছেলে বাচ্চার মনে গেঁথে দেওয়া হয় সে পরিবারের উত্তরসূরি এবং ভবিষ্যতে পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিতে হবে তাকেই।অনেক ক্ষেত্রেই এই দায়িত্ববোধ তার কিশোর বা তরুণ বয়সে মানসিক চাপের কারন হয়ে দাঁড়ায়।
শিক্ষা:একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে শিক্ষাক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় মোটামুটি ৮% বেশি প্রাধান্য পায়।কিছু কিছু ক্ষেত্রে অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু বিষয় ছেলেরা পড়বে আবার কিছু বিষয় মানেই সেখানে মেয়েদের আধিক্য।যেমন গণিত মানেই একটা মাসকুলাইন ব্যাপার।এই সমস্ত স্টিরিওটাইপ ব্যাপার ছেলেদের আকাঙ্খা ,ব্যবহার এমনকি সাংসারিক জীবনে অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
পেশাগত জীবন:
কাজের জায়গায় পুরুষরা বঞ্চনার স্বীকার একথা শুনলে অনেকেই হেসে গড়াগড়ি যেতে পারেন।কিন্তু আসল সত্যিটা এই যে শুধুমাত্র পুরুষ হবার কারনেই অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় পুরুষ কর্মীর উপরে।ছুটির ক্ষেত্রেও হতে হয় বঞ্চনার স্বীকার।সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মেয়েরা যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করেন পুরুষের ক্ষেত্রে পিতৃত্বকালীন ছুটি কোথাও নেই আবার কোথাও তা এতোটাই নগন্য যে সদ্য বাবা হওয়া পুরুষটি তার দায়িত্বটুকু করবার সুযোগ যেমন পাননা তেমনি সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তানের পাশে না থাকতে পেরে মানসিক যন্ত্রণায় জর্জরিত হন।
নাগরিক বৈষম্য:
পুরুষ মানেই প্রথম শ্রেণীর নাগরিক এই সুবিধে যেমন অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান।আবার তেমনি পুরুষ হবার কারনেই নানান সমস্যার স্বীকারও হন অনেকে ছেলেই।সমাজের অনেক নিয়ম এমনকি আমাদের দেশের কিছু আইনও মেয়েদের এমন এক রক্ষাকবচ দিয়েছে যার কুপ্রয়োগ ঘটে চলেছে অনেক ক্ষেত্রেই।Dowry prohibition act,1961 বা 498 এরকমই কিছু আইনের ধারা।শুধুমাত্র স্বামীকে এবং তার বাড়ির লোকদের অপদস্থ করবার লক্ষ্যে এই দুটি আইনের অপপ্রয়োগ অনেক স্ত্রীই করেছেন।বহু ক্ষেত্রে স্বামী বাধ্য হয়েছেন পাহাড় প্রমাণ খোরপোষের দাবি মেনে নিতে ।অথবা কেউ
কেউ আত্মহত্যায় খুঁজেছেন মুক্তির পথ।এছাড়া যৌন অত্যাচার বা যৌন হেনস্থার মিথ্যে অভিযোগের প্রমাণ রয়েছে ভুরি ভুরি।
যৌন হেনস্থা:
রামায়ণ,মহাভারতের সময় থেকেই নারী এক যৌন পদার্থ আর পুরুষ সেই যৌনভোগী।এখনকার সময়েও মেয়েদের যৌন হেনস্থা যে কিছু কম হয়েছে তা না।রোজই খবরের কাগজে রেপ ,গাং রেপ এর খবর।এমনকি নিজের আত্মীয় মায় বাবা পর্যন্ত ভোগ করেন মেয়েকে।কিন্তু প্রদীপের আলোর থেকে একটু দূরে যে আরেকটি চিত্রপট রয়েছে তা অনেকেরই জ্ঞাত নয়।অনেক ছেলেও যৌন নিপীড়নের স্বীকার হয়।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে ঘটনাগুলি সামনে আসেনা কারন পুরুষের সহজাত ইগো সমস্যা।পুরুষ হয়েও সে অত্যাচারিত হয়েছে এই লজ্জা তারা প্রকাশ করতে পারেনা।বিশেষ করে কাজের জায়গায় মহিলা বস বা সহকর্মীর কাছে যৌন হেনস্থার ঘটনা এখন এক বড় সমস্যা।২০১৫তে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার করা সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী চেন্নাই ,ব্যাঙ্গালোর ,মুম্বই ,দিল্লি ,কলকাতার মত শহরে work place sexual harashment of male persons প্রায় ১৯%।তাছাড়া আত্মীয় ,বন্ধু অথবা শিক্ষকের কাছে নিপীড়িত হবার ঘটনাও ঘটে।
এমন আরো জেন্ডার ইনইকুয়ালিটির ঘটনা রোজ ঘটছে চারপাশে।যার প্রভাব নারী ,পুরুষ নির্বিশেষে পড়ছে গোটা সমাজের উপরেই।এই খারাপ দিকগুলো কাটিয়ে উঠতে ,বৈষম্য মেটাতে আমাদের দেশেও ২০০৭ সাল থেকে উদযাপিত হয়ে আসছে পুরুষ দিবস।সমাজের প্রতি ,পরিবারের প্রতি ,কাজের জায়গায় ছেলেদের প্রতিদানকে স্বীকৃতি দিতে ,তাদের মানসিক ,সামাজিক সমস্যায় তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকারকে নতুন করে মনে করিয়ে দেবার জন্য পুরুষ দিবসে এই উদযাপন চলছে আমাদের দেশ সহ প্রায় ৮০টি দেশে।বিভন্ন এনজিও এখন ছেলেদের নাগরিক অধিকারের জন্য কাজ করছে।অবশ্য যেদিন আমার নিজেদের ভাবনার পরিবর্তন করতে পারবো ,ছেলে মেয়ে সবাইকে মানুষ ভাবতে শিখবো সেদিনই হয়তো লিঙ্গ বৈষম্য নিরসনের ভাবনা বাস্তবে ফল পাবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব।
আপনাদেরই কথা থাকতে পারে।লিখে পাঠান আমাদের ই–মেলে)
0 Comments