সেখ মনোয়ার হোসেন
মধ্যযুগে সুবে বাংলার শরিফাবাদ অর্থাৎ বর্ধমান সবথেকে বড় জমিদারি ছিল। আর এই জমিদারের নাম রাজা তেজ চাঁদ।এই জেলায় এমন কিছু জিনিস রয়েছে যেগুলো নিয়ে হয়তো খুব বেশি আলোচনা হয়নি অথচ এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। ইতিহাস বলছে, "এমন আশ্চর্য একটি ফলক লুকিয়ে আছে সর্বমঙ্গলা বাড়ি চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা কমলেশ্বর শিব মন্দিরের জগতী অংশে। আয়তাকার ফলকটি প্রস্থে প্রায় সাড়ে উনিশ ইঞ্চি ও উচ্চতায় সাড়ে চার ইঞ্চি। প্রথম দর্শনে সমুদ্রমন্থন বলে ভুল হলেও খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে ডান দিকে আট জন গোড়া সৈনিক আর বাঁদিকে সাতজন নেটিভ সিপাই অস্ত্র বন্দুক হাতে 'সাবধান' ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। তারপর এক এক সারিতে চারটি করে কামান নিয়ে আট আট জন মোট ষোলোটি চাকা লাগানো কামান। অনুভূমিকভাবে লম্বা ফলকের ঠিক মধ্যস্থলে একটি মিনার। স্পষ্টতই মিনারটিই সমস্ত আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু। মিনারের মাথা গম্বুজাকৃতি, একটি চুড়া আছে। সমস্ত মিনারটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত এবং সর্বাঙ্গে সর্বাঙ্গে ফ্লুটিং বা বেণুডন্ডের দৌল।" (বর্ধমানের শিকড় সন্ধান)
"ফলকটি অনুভূতিক তলে প্রায় সাড়ে উনিশ লম্বা ও উচ্চতায় মাত্র সাড়ে চার ইঞ্চি। এই সামান্য পটে আট জন ইংরেজ ও সাতজন নেটিভ সেপাই তাদের অস্ত্র ,কাঠামো সহ ১৬ টি চাকা লাগানো কামানের স্থান করে দেওয়া হয়েছে অসামান্য দক্ষতায় ।মাঝখানে আছে তুর্কি গম্বুজ, মিশরীয় বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত সিরিয় ফ্লুটিং সহ মিনার টি রচনা কৌশলে সামান্য আয়োজনে মাঠের পরিস্ম রচনা হয়ে যায়"।(বর্ধমানের শিকড় সন্ধান)
Photo credit: Sk. M. Hossain |
এই ফলকটি সন্বন্ধে "বর্ধমানের শিকড় সন্ধান" পুস্তকের রচয়িতা প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ "সঞ্জীব চক্রবর্তী" ব্যতীত কোন ইতিহাসবিদ এ বিষয়ে উচ্চবাচ্য একটি শব্দ ব্যবহার করেনি বা লেখেননি বা দেখেননি। তবে সঞ্জীব চক্রবর্তীর মতে রামেশ্বর ও কমলেশ্বর মন্দির দুটি তেজ চাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হলেও এই ফলকটি পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছে।
এই ফলক বিষয়ে আমি যতদূর অনুভব করেছি তাতে বেশ কিছু গোপন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সুবে বাংলার মুসলিম সাম্রাজ্যের ও পতন ঘটে। এই এই পতনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ইঙ্গিত টেরাকোটার ফলকের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে লুকিয়ে আছে।
ফলকটি লক্ষ্য করলেই দেখা যায় মূল আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু ঐ মিনারটি। মিনার ফারসি বা তুর্কি শব্দ যা মানার বা মানারা শব্দের ভারতীয় রূপ মিনার। মিনার শব্দের অর্থ উঁচু স্তম্ভ। মিনার হল মসজিদের সাথে যুক্ত স্থাপত্য যাতে থাকে ভিত্তি, উথিত অংশ ও একটি গ্যালারি এবং মিনার মসজিদ থেকে উঁচু হয়। শীর্ষ ভাগ সূচালো বা পেঁয়াজের আকৃতি হয়ে থাকে। আজানের আওয়াজ দূরে পৌঁছানোর জন্য মিনারের ব্যবহার হয়।
মিনার ইসলামিক ধর্মীয় স্থাপত্য এবং ইসলামিক গৌরবের প্রতীক যা সুউচ্চ স্তম্ভ ও বিশেষ গৌরবময় স্মৃতি চারণের প্রতীক। এখানে এই মিনারটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। এই পাঁচ ভাগেই গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে ,যেমন এক একটি অংশ অর্থাৎ শুবে বাংলার স্বাধীন নবাব নবাব গণের প্রতীকি প্রতীক ১) নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ( ১৭১৭ থেকে ১৭২৭)। ২) নবাব সুজাউদ্দিন মোহাম্মদ খান (১৭২৭ থেকে ১৭৩৯) ৩) নবাব সরফরাজ খান বাহাদুর ( ১৭৩৯ থেকে ১৭৪০) ৪) নবাব মোহাম্মদ আলীবর্দী খান বাহাদুর (১৭৪০ থেকে ১৭৫৬) ৫) বাংলার শেষ নবাব মোহাম্মদ সিরাজ উদ দ্দৌলা (১৭৫৬ থেকে ১৭৫৭ ২৩ শে জুন, মৃত্যু ২ জুলাই ১৭৫৭) ।
মিনারটি ডানদিকে আট জন গোড়া সৈনিক /ব্রিটিশ সৈনিক অস্ত্র সহ ৮ টি কামান নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞের জন্য সাবধান অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে । অনুমান এই ৮ জন অর্থাৎ ১) রবার্ট ক্লাইভ ২) মেজর কিল প্যাট্রিক ৩) মেজর গ্রান্ট ৪) মেজর আইরি কুট ৫) ক্যাপ্টেন গপ্ ৬) ক্যাপ্টেন রিচার্জ নক্স ৭)এডমিরাল ওয়াটসন ৮) ওর্ম ( ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দরবারী) ইত্যাদি। মিনারটির বাঁদিকে সাতজন নেটিভ সিপাই অস্ত্র হাতে সাবধান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অর্থাৎ সাতজন রাজা বা জমিদার এই মিনারটি ধ্বংসের জন্য দণ্ডায়মান। অনুমান ১) রাজা স্বরূপ চাঁদ ২) রাজা মহেন্দ্র ৩) রাজা রাজবল্লভ ৪) রাজা নন্দকুমার ৫) রাজা কৃষ্ণদেব রায়চৌধুরী ৬) রানী ভবানী ৭) রাজা রাম নারায়ণ , ইত্যাদি।
একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারা যাবে মিনারটি কে ধ্বংসের জন্য আটটি করে ১৬ টি কামান মজুদ আছে। আট জন গোড়া অর্থাৎ ব্রিটিশ সৈন্য উপস্থিত এবং ৭ জন দেশীয় সৈনিক উপস্থিত কিন্তু আটটি কামান বিদ্যমান , এখানেই একটি ইঙ্গিত লুকানো আছে। অর্থাৎ বর্ধমানের জমিদার রাজা তিলক চাঁদ গোপনে ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়ে মিনারটি ধ্বংসের অর্থাৎ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পাঁচ পুরুষের গৌরবের প্রতীক ( মিনার )পতনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন , কিন্তু নিজে উপস্থিত ছিলেন না।
১৭৫৭ পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পতন হলে সিরাজউদ্দৌলার কলকাতার গভর্নর (ফৌজ) রাজা মানিক চাঁদ বর্ধমান ফিরে আসেন এবং বর্ধমানের জমিদার তিলক চাঁদের দেওয়ান হিসেবে যোগদান করেন এবং বিপুল গৌরব অর্জন করে ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।(বর্ধমান সহায়িকা)
দেওয়ান মানিকচাঁদ লর্ড ক্লাইভকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখলেন, "নাজিমের পীড়নে আমার আর কিছু অবশিষ্ট নেই। গত তিন বছরে আমি সব ক্ষমতা হারিয়েছি। আমার কর্মচারীরাও আর আমার কথা শোনে না। ঈশ্বরের আশীর্বাদে আপনি এসেছেন। এবার দেশের বৃদ্ধি হবে।"(বর্ধমান সহায়িকা)
পুরস্কার স্বরূপ "ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট হতে মহারাজা তিলক চাঁদ খিলাত পান ১৭৬০, ২৪ শে ডিসেম্বর)(বর্ধমান রাজ ইতিবৃত্ত)। সবটাই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে যুক্তি দাড় করিয়েছি কারণ কোন ইতিহাসবিদ এ বিষয়ে বিন্দু বিসর্গ কিছুই লেখেননি। এমনকি বর্ধমান রাজ বংশানুচরিত নিশ্চুপ। ইতিহাস গবেষক ছাত্রদের আগামী দিনের গবেষণার জন্য ফলকের অলক্ষিত বিষয় ছেড়ে দিলাম।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার -: ইতিহাসবিদ সঞ্জীব চক্রবর্তী মহাশয়ের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা না পেলে এই ফলকটি আদৌ খুঁজে পেতাম না। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি।
তথ্যসূত্র-:" বর্ধমানের শিকড় সন্ধান"- সঞ্জীব চক্রবর্তী।"বর্ধমান সহায়িকা"- বর্ধমান : অতীত থেকে বর্তমান- ড . সর্বজিত যশ । "বর্ধমান রাজ ইতিবৃত্ত" নীরদবরণ সরকার ।
0 Comments