মুসলিম–বিদ্বেষ কলকাতার কলেজে, চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলেন হিজাবী অধ্যাপিকা

বেঙ্গল মিরর ডেস্ক: বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় দেশের নানান প্রান্তে যখন উত্তেজনা, তখন শান্ত ছিল কলকাতা। সেইসময় পরিস্থিতি শান্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। এখন অবশ্য সরকার পালটেছে।কিন্তু এই সরকারের আমলে  মুসলিম বিদ্বেষ বাড়ছে। তিন বছর আগের বিজেপি শাসিত কর্নাটকের মতো পশ্চিমবঙ্গেও হিজাব পরার জন্য ছাত্রী ও অধ্যাপিকাকে হেনস্থা ও চাকরি ছাড়া করা হয়েছে।

আগে পশ্চিমবাংলা মোটের উপর কট্টরপন্থীদের  থেকে মুক্ত ছিল এবং পশ্চিমবাংলার ঐতিহ্যবাহী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মডেল ছিল সারা দেশে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় বলে থাকেন, কে কী খাবে, কে কী পরবে তা জোর করে কেউ ঠিক করে দিতে পারে না। এ অধিকার সংবিধান কাউকে দেয়নি।  কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবাংলাতেও গেরুয়াপন্থী মনোভাবের ভূত ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। আর তা হয়েছে খোদ পশ্চিমবাংলার রাজধানী কলকাতাতেই। এল. জে. ডি ল’কলেজেই (লক্ষ্মী জিতেন্দ্রনাথ দাস ল’কলেজ) আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করার এই ঘটনাটি ঘটেছে। যার জেরে একজন মুসলিম মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরকে চাপের মুখে চাকরি থেকে রিজাইন করতে হয়েছে। তাঁর অপরাধ, তিনি পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী মাথায় স্কার্ফ পরে কলেজে আসছিলেন। আর প্রায় ওই সময়ই ওই ল’ কলেজে পাঠরতা একজন হিজাব পরিহিতা ছাত্রীকে এল. জে. ডি ল’ কলেজের ৪-৫ জন পুরুষ স্টাফ একটি ঘরে ঢুকিয়ে হিজাব খোলার জন্য তার উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। তাকে বলা হয়, তুমি যদি মাথায় স্কার্ফ বাঁধো তা কলেজের ড্রেস কোডকে লঙ্ঘন করবে। তোমার ড্রেস অন্য ছাত্রীদের উপর ম¨ প্রভাব ফেলবে। হিজাব পরিহিতা আইনের ছাত্রীটি জবাব দেয়, মাথা ঢেকে রাখা আমার বিশ্বাসের অঙ্গ। আমি ড্রেস কোডের পোশাক পরেই মাথায় হিজাব রেখেছি। সাদা ওড়না পরিধানের অনুমতি এই কলেজের ছাত্রীদের জন্য ড্রেস কোডে রয়েছে। আমি মাথায় সাদা হিজাবই নিয়েছি। আর আমি দীর্ঘদিন ধরেই হিজাব পরে ক্লাসে আসছি। আমার ভর্তি হওয়ার সময়ও বলা হয়নি মাথায় হিজাব পরা যাবে না। ওয়েবসাইড বা গাইড বুকেও এই ধরনের কোনও কথা উল্লেখ নেই। হঠাৎ কেন আপনারা নতুন নিয়ম করছেন? কেন আমাকে মাথার কাপড় খুলে ফেলার জন্য বাধ্য করার চেষ্টা করছেন? 



এইসব কথাবার্তা যখন হচ্ছিল তখন কলেজ কর্তৃপক্ষের একজনের মনে পড়ে ঘরে সিসিটিভির ক্যামেরা রয়েছে। তখন ওই পুরুষ স্টাফরা ওই হিজাব পরিহিতা মেয়েটিকে অন্য একটি রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হিজাব খুলে ফেলার জন্য পুনরায় চাপ দিতে থাকে। ওই তরুণী ছাত্রীটি দেখে সে পুরুষ পরিবৃত হয়ে একটি বন্ধ ঘরের মধ্যে রয়েছে। মেয়েটি বলে সে কখনই হিজাব খুলবে না। একটু পরে তার ভাইভা রয়েছে, তাকে যেন ওই ভাইভা দিতে ঘর খুলে দেওয়া হয়। এই সময় অভিজিৎ ও ডেভিড নামধারী কলেজের দুই স্টাফের মধ্যে একজন কাউকে ফোন করে জানান, এই মুসলিম মেয়েটি তো ভয় পাচ্ছেই না, বরং সে হিজাব না খোলার বিষয়ে অনড় রয়েছে। ছাত্রীটিকে দেড় ঘণ্টা ধরে হয়রানি করে দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং ছাত্রীটি কোনওক্রমে ভাইভা দিয়ে কলেজ থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় বেরিয়ে যায়। সে পুবের কলম-কে বলে, আমি মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে, বাড়িতে ফোন করে সব জানাই। আমার একজন অভিভাবক এসে আমাকে বাড়ি নিয়ে যায়। আমার একজন অভিভাবক ফোন করে কলেজ কর্তৃপক্ষকে বলেন, আপনারা আমাদের মেয়ের উপর যেভাবে মানসিক নির্যাতন করেছেন তা গুরুতর অন্যায়। এ বিষয়ে আমরা অবশ্যই পদক্ষেপ করব। কলেজ থেকে বলা হয়, আমাদের দু’জন নতুন স্টাফ এগুলি করেছে। আমরা তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। 

মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার ওই ছাত্রীটি প্রায় কাঁদতে কাঁদতে পুবের কলম প্রতিবেদককে বলে, আমি যখন আটকে থাকা অবস্থায় কলেজের ওই কর্তৃপক্ষদের বললাম আমাদের হিন্দুসহপাঠিনীরা যাদের বিয়ে হয়েছে তারা শাঁখা-সিঁদুর পরে আসে। তাহলে কী সেগুলি আপনারা বন্ধ করবেন? কলেজ কর্তৃপক্ষ জবাব দেন, না এগুলি তো তাদের বিশ্বাসের অঙ্গ, সেগুলি চলবে। আরও মিথ্যা করে বলা হয়, আমাদের সহপাঠীরাই নাকি আমার মাথায় স্কার্ফ বাঁধার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছে। পরে আমি জেনেছি, এগুলি ডাহা মিথ্যা কথা। 

যে মুসলিম মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরকে মাথায় স্কার্ফ পরার কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয় তাঁর নাম সনজিদা কাদির। তাঁর বাড়ি বীরভূম। তিনি এক সময় পশ্চিম বাংলার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম মোতাহার হোসেন সাহেবের নাতনি। সনদিজা পুবের কলম-কে বলেন, হঠাৎই অশোক দাস নামে কর্তৃপক্ষদের একজন আমাকে ডেকে বলেন, আপনার হিজাব পরে কলেজে আসা চলবে না। কেন জিজ্ঞাসা করলে বলা হয়, এটা আমাদের ড্রেস কোডের উল্লঙ্ঘন করছে। তিনি বলেন, আমি তো বেশ কিছুদিন ধরে মাথা আবৃত করা হিজাব পরে আসছি। কেউ তো বাধা দেয়নি। আর প্রফেসরদের জন্যও ড্রেস কোড আছে, এটা এই প্রথম শুনলাম। আপনাদের ওয়েবসাইট বা গাইড বুকেও এই কথা উল্লেখ নেই। অধ্যাপিকা সনজিদা ওই কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করেন, যদি কোনও শিখ পাগড়ি পরে আসেন, তাহলে কী আপনারা তাঁকে ক্লাস করতে কিংবা পড়াতে দেবেন না? কর্তৃপক্ষ বলেন, শিখদের বিষয়টি আলাদা। এখানে আপনি হিজাব পরতে পারবেন না। সনজিদা এবং মুর্শিদাবাদের ছাত্রীটিকে বলা হয়, এটা কোনও রিলিজিয়াস ইন্সটিটিউশন নয়। আমরা একটি ‘নিউট্রাল স্পেস’ তৈরি করতে চাইছি। এখানে কোনও ধর্মের ধর্মীয় কার্যকলাপ চলবে না। তখন কলেজ কর্তৃপক্ষকে সনজিদা এবং ওই মুর্শিদাবাদের ছাত্রীটিও বলেন, যদি এই কলেজ ‘নিউট্রাল স্পেস’ হয় তাহলে কী করে এই কলেজে সরস্বতী পুজো হয়, দোল খেলা হয়। কলেজে লক্ষ্মী-সরস্বতীর মূর্তি আছে, সেখানে প্রায় প্রতিদিন ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। তাহলে তো একটি ধর্মকে এখানে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, নিউট্রাল তো হচ্ছে না। 

এ বিষয়ে পুবের কলম থেকে ফোন করা হয়েছিল কলেজের কর্তৃপক্ষের প্রধান চেয়ারম্যান গোপাল দাসকে। তিনিও এক কথা বলেন। এই কলেজ সব ধর্মের জন্য। কোনও বিশেষ ধর্মকে এখানে জায়গা দেওয়া হবে না। তাঁকে বলা হয়, তাহলে সরস্বতী পুজো বা দোল কী করে এখানে উদ্যাপিত হয়? গোপাল দাস বলেন, ওটা আমরা করি না, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা করে। আর এগুলি হয় ক্যাম্পাসের বাইরে। তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় গত বছরও কলেজের একটি ঘরে সরস্বতী পুজো হয়েছে। তার ছবি পুবের কলম-এর কাছে রয়েছে। তিনি এর উত্তর না দিয়ে বলেন, শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীদের ড্রেস কোড মানতে হবে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, এতদিন এই নিয়ম কেন মানা হয়নি? অনেক হিজাবপরা ছাত্রী তো এই কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে গেছে। চেয়ারম্যান গোপাল দাস বলেন, এখন আর এসব চলবে না। ত¥াকে প্রশ্ন করা হয় কেন একজন সংখ্যালঘু ছাত্রীকে পুরুষ স্টাফরা দরজা বন্ধ করে মানসিক হয়রানি করল, কাপড় খুলতে বলল? তিনি বলেন, আমাদের নতুন স্টাফ ডেভিড ও অভিজিতকে এ জন্য শোকজ করা হয়েছে। আর ছাত্রীটি ও তার অভিভাবকদের সঙ্গে আমরা মিটমাট করে নিয়েছি। বেলডাঙার ওই ছাত্রীটিকে ফোন করা হলে সে জানায়, কোনও মিটমাট হয়নি। 

(সৌজন্যে পুবের কলম)

Post a Comment

0 Comments