আসিফ রেজা আনসারী
সম্প্রতি নওশাদ সিদ্দিকীর সঙ্গে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক, ফুরফুরায় মুখ্যমন্ত্রীর ইফতার মজলিশ, একইসঙ্গে পার্ক সার্কস ময়দানে কলকাতা কর্পোরেশনের ইফতার মাহফিলে ফুরফুরার দুই পীরজাদা আগমন, বেশ কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি করছে বাংলার মুসলিম সমাজকে। আর প্রশ্ন উঠবে নাইবা কেন? বাংলার শিক্ষিত মুসলিম, দলিত, আদিবাসী তথা পিছিয়েপড়া সমাজের মানুষ কোন দিকে যাবেন, নেতৃত্ব তৈরি হবে কিনা নাকি আবারও বিশ্বাস ভঙ্গতার মধ্যে পড়বেন নওশাদ সিদ্দিকীরা, এমন বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে।
একটা কথা বরাবরই বলা হয় যে, শিক্ষিত, সচেতন এবং সমাজের জন্য সত্যিকারের কিছু করতে চায় এমন মানুষ রাজনীতিতে আসা দরকার। সক্রিয় রাজনীতি না করলেও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমেও মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে বড় ভূমিকা রাখা যায়। বিশেষ করে ২০১৮-১৯ এর পর থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এমনটাই স্বপ্ন জাগিয়েছিল বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ। বিশেষ করে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের উপর নিপীড়ন, মানুষের প্রতি বঞ্চনা এবং সমাজের বুকে হয়ে চলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল এই সংগঠনটি।
![]() |
প্রতীকী ছবি |
এমন বহু মানুষ আছেন যারা এই সংগঠনের সামনের সারিতে না থাকলেও দিনরাত এক করে কাজ করেছেন, শুধু মানুষের কথা ভেবে। কিন্তু দেখা গেল এক বিশেষ মুহূর্তে সংগঠনের দুই মুখ তন্ময় ঘোষ এবং অধ্যাপক সামিরুল ইসলাম, দুজনেই একে একে শাসকদলে ভিড় জমালেন। ব্যক্তিগতভাবে একজন পশ্চিমবঙ্গ স্বরোজগার নিগমের চেয়ারম্যান, অন্যজন রাজ্যসভার সাংসদ হলেন। দুজনেই এর আগে ভালো জায়গায় ছিলেন। কিন্তু তারা সংগঠনের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে সরাসরি যোগ দিলেন শাসকদলে। যে দলের বিরুদ্ধে বলগাহীন দুর্নীতি, সীমাহীন নির্যাতন, ঘুষ লুটরাজ এবং সন্ত্রাসের নানান অভিযোগ আছে। বাম আমলে একসময় মানুষের কণ্ঠস্বর প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল একথা স্বীকার করতেই হয়। কিন্তু তৃণমূল আমলে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগ একপ্রকার অবাস্তব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরেও মানুষ আপাতদৃষ্টিতে বিজেপির হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকার জন্য তৃণমূলকে বেছে নিয়েছেন। যেকোনো দেশে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক শক্তিশালী বিরোধী দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার রাজনীতিতে বিজেপি সেই কাজটা করতে পারছে না। তাদের সাম্প্রদায়িক নীতির কারণে মানুষের অধিকারের কথা সেভাবে উঠে আসছে না। বরং বিদ্বেষ এবং বিভাজনের রাস্তা আরও প্রকট হচ্ছে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে মানুষের মনের কথা, শিক্ষিত প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরার একমাত্র মুখ ছিলেন আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী।
![]() |
ফুরফুরা শরীফের অনুষ্ঠানে। ছবি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে |
তিনি যেহেতু ধর্মে মুসলমান। তাই স্বাধীনভাবে বিকল্প শক্তি হয়ে ওঠা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না শাসকদল। আসলে তৃণমূলের আরএসএস সখ্যতা এর প্রধান কারণ। বর্তমানে এমন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে হয় নওশাদকে তৃণমূলে ঢুকতে হবে, নতুবা সেই বংশেরই কাউকে দিয়ে নাস্তানাবুদ করা হবে আগামী নির্বাচনে।
স্বাভাবিকভাবে উভয় সংকটে পড়ছেন ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা। পীর বাড়ির অন্দরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সুস্পষ্ট ফাটল রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন। আর সবটাই করছেন তার রাজনৈতিক ফায়দা, পিছিয়েপড়া সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বরকে চিরতরে মুছে দেওয়া এবং আরএসএস লাইনে চলা সহজ করতে।
এতগুলো প্রশ্ন বা বিষয়ের অবতারণা এই কারণে যে মঙ্গলবার পার্ক সার্কাস ময়দানে কলকাতা পুরনিগমের ইফতার মজলিসে ফুরফুরা শরীফের পীরজাদাদের উপস্থিতি এবং ত্বহা সিদ্দিকীর মন্তব্য বেশ কিছু বিষয় সামনে এনে দিয়েছে। সোমবার ফুরফুরা শরিফের পর মঙ্গলবার পার্ক সার্কাসে ফিরহাদ হাকিমের ইফতার অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর পাশের চেয়ারে বসে আগাগোড়া কথা বলতে দেখা গেল নওসাদের তুতো ভাই কাসেম সিদ্দিকিকে। সঙ্গে ছিলেন আর এক তুতো ভাই নাজিমুদ্দিন হোসেনও!
আর হাটে হাড়ি ভেঙেছেন ত্বোহা সিদ্দিকী। মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমে তার সোজাসাপ্টা বক্তব্য, "আপনি লিখে রাখুন, নওশাদকে মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনতেই হবে! হয় তৃণমূলে যেতে হবে, নয় আগামী দিনে নিজের পরিবারের কারও সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে মুখোমুখি হতে হবে।"
কেউ কেউ বলছেন, ভাঙড়ের বিধায়ক তৃণমূলে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে আইএসএফের জন্য একাধিক আসন দাবি করতে পারেন। তবে ত্বোহা সিদ্দিকীর দাবি, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নওশাদের ওই প্রস্তাবে রাজি হবেন না। সেক্ষেত্রে নওশাদের সামনে দুটো পথ খোলা থাকবে, হয় তৃণমূলে যোগ দাও, নয়তো ওর ঘরেরই কাউকে ওর বিরুদ্ধে আগামী নির্বাচনে দাঁড় করাবে তৃণমূল। তাতে নওশাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরও বড় প্রশ্নের মুখে পড়বে।"
এ নিয়ে নওশাদের অবশ্য কোনও বক্তব্য এই।
তবে এ কথা ঠিক যে ফুরফুরা শরীফের যে অংশ কাটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতিতে পা বাড়িয়ে নওশাদের বিপক্ষে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কিংবা নওশাদকে দলে টেনে ভাবছেন কিছু হবে, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করে নিজস্ব আত্মপরিচিতি বিনির্মাণের জন্য নওশাদ যতটা জনপ্রিয় হয়েছেন, তৃণমূলে গেলে তিনি যেমন অস্তিত্ব হারাবেন, একইসঙ্গে বাংলার মুসলিম দলিত ও পিছিয়েপড়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠান লড়াই চিরতরে মাটিতে মিশে যাবে। আর স্বাভাবিকভাবে ব্রাহ্মণ্য গোষ্ঠীর দ্বারা বারংবার রাজনৈতিকভাবে লাঞ্ছিত এবং বঞ্চিত থাকবে এই সমাজ।
এখন ফুরফুরা শরীফের পীরজাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা এভাবে ভোট ব্যাংক হয়ে থাকবেন নাকি, একটি শক্তিশালী বিরোধীদল তৈরি করে সরকারকে জনমুখী করা এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠান লড়াইকে মজবুত করবেন। সোমবার দেখা গেল পীরজাদারা শুধু নিজেদের দাবি-দাওয়াই জানালেন। কেউ একবারে বললেন না রাজ্যের ৬০০টি মাদ্রাসায় ১৫ হাজার শিক্ষকের শূন্যপদ কিভাবে পূরণ হবে? রাজ্যে ৩০ শতাংশ মুসলিম থাকা সত্ত্বেও কেন শিক্ষা, চাকরি বা অন্যান্যক্ষেত্রে এখনও তাদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে। রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, সরকারের পদক্ষেপ কি? স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো উন্নয়নে সরকার কোনও পদক্ষেপ করবে কিনা এসব জ্বলন্ত বিষয় অনালোচিতই থেকে গেছে।
0 Comments