আসিফ রেজা আনসারী
জাহানারা বেগম চৌধুরী ওরফে মীরা শুধু একজন পত্রিকা সম্পাদক, কবি কিংবা সাহিত্যিকই নন, তিনি একজন শিল্পীও বটে। জানা যায়, ১৯৩৬ সালে বড়দিন উপলক্ষে লখনউ শহরে একটি শিল্প প্রদর্শনী হয়েছিল। এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন জাহানারা বেগম চৌধুরী। আর তার নিজ হাতে তৈরি কাঁথা জিতে নিয়েছিল প্রথম পুরস্কার। সেই সময় মাত্র ২৩ বছর বয়সী এক শেরশাবাদিয়া ঘরের বেটি তথা সূচী-শিল্পী জাহানারা বেগম চৌধুরীর হাতের কাজ সবার নজর কাড়ে।
সূঁচ-ধাগা দিয়ে তৈরি জাহানারা চৌধুরীর হাতে তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের কাঁথা, পানের বাটা, কুরআন রাখার গেলাফ, হাত-পাখা, রুমাল ইত্যাদি শিল্প প্রদর্শনীর বিচারকদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। সেই সময় বিভিন্ন খবরের কাগজে শিল্পীর ছবি দিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। যতদূর জানা যায় প্রখ্যাত নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও জলধর সেনের নাম-করা মাসিক পত্রিকা ভারতবর্ষর পাতায় খবর প্রকাশিত হয়। ভারতবর্ষ পত্রিকায় শিরোনাম ছিল "বাঙ্গালী বালিকার কৃতিত্ব"।
![]() |
বাঁ দিকে ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর, ডানে জাহানারা বেগম চৌধুরী। |
তাতে লেখা হয়। "গত বড়দিনের সময় লক্ষ্ণৌ শহরে যে শিল্প প্রদর্শনী হইয়াছিল তাহাতে সূচীশিল্প প্রদর্শন করিয়া কুমারী জাহান-আরা বেগম চৌধুরী প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছেন ও সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করিয়াছেন। তিনি শুধু শিল্পী নহেন তিনি একজন ভালো লেখিকা; "বর্ষবাণী" নামক বার্ষিক পত্র সম্পাদন করিয়া তিনি খ্যাতি লাভ করিয়াছেন। ইতিপূর্বে বাঙ্গালা ও বিহারের বহু প্রদর্শনীতে নিজ শিল্প কার্য প্রদর্শন করিয়া কুমারী জাহান-আরা যশলাভ করিয়াছেন।"
সাহিত্যিক জাহানারা বেগম চৌধুরী একজন জমিদার পরিবারের শেরশাবাদিয়া ঘরের কন্যা। অবিভক্ত মালদার মনাকষা গ্রামে ১৯১৩ সালে তার জন্ম। মনাকষার জমিদার পরিবারের একটি বাড়ি ইংরেজবাজার শহরে এখনও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ ছিল এমনকি কাজী নজরুল ইসলাম তাকে নিয়ে বেশ কিছু লেখাও লিখেছিলেন তার ভাই আলতাফ চৌধুরী সাহিত্যচর্চায় বিশেষভাবে জাহানারা চৌধুরীকে সাহায্য করতেন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে যে বেশ কয়েকজন নারীর ভালো যোগাযোগ করে উঠেছিল যারা তার সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও নিজেদের সক্রিয় অস্তিত্ব তুলে ধরতে সক্ষম হন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জাহানারা বেগম চৌধুরী ওরফে মীরা। বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়, জাহানারা বেগমের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম পরিচয় হয় ১৯৩১ সালে। দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে দেখা হয় তাঁদের। সেই সময় নাকি দার্জিলিঙে বেড়াতে গিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মৈত্রয়ী দেবী, ড. সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র প্রমুখ।
কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে জাহানারা চৌধুরীর যোগাযোগ প্রসঙ্গে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন-
“জাহানারা বেগম চৌধুরী ছিলেন মুসলিম সমাজের মেয়ে। হিন্দু সমাজের মেয়েরা তখন একটু অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু জাহানারার মত-অতটা যাকে বলে ‘ফরোয়ার্ড’-হিন্দু মেয়েরাও ছিল না। আগে ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা পত্রিকা বের করতেন যেমন স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী এবং মাত্র কয়েকজন। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে একেবারে পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে চলা, সংগ্রাম করে যাওয়া-জাহানারা যা দেখিয়ে গেছেন, তার আগে অন্তত কোনও মহিলা দেখাতে পারেননি। তার চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, মাধুর্যের সাথে ছিল তেজস্বিতা। সব মিলিয়ে তিনি কিছু বললে, সেটা অস্বীকার করা যেত না”।
কাজী নজরুল ইসলামের একটি গানের খাতা জাহানারা চৌধুরীর কাছে ছিল বলে জানা যায়। যেগুলি তার মৃত্যুর আগে তিনি প্রকাশের অনুমতি দিয়ে যান।
কাজী নজরুল ইসলামের দার্জিলিং পর্ব সম্পর্কে সেকালের লেখক-সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল লিখেছেন, ‘এমনি করে একটা সময়ে একটি সাহিত্যোত্সাহী ও সুশ্রী তরুণী লেখকসমাজের মধ্যে কোথা থেকে যেন ছটকিয়ে আসে। মেয়েটির দেহলাবণ্য ও নবীন তারুণ্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওর মিষ্ট মুখশ্রী মধুর হাসি, ভদ্র ব্যবহার এবং প্রত্যেক লেখক-লেখিকার প্রতি আন্তরিক অনুরাগ—ওকে অল্প কালের মধ্যে সকলের প্রিয় করে তোলে।’
অন্যদিকে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও লেখক কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যা যোবায়দা মির্যা জাহানারা চৌধুরী সম্পর্কে বলতেন ‘বিখ্যাত সুন্দরী' যেমন আর বন্দে আলী মিয়ার চোখে ‘জাহানারা অসামান্য রূপবতী’। দার্জিলিংয়ের যে ডাক বাংলোতে উঠেছিলেন আলতাফ চৌধুরী ও তার বোন জাহানারা সেখানে নজরুলও গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
তথ্য সহায়তা: ড.আবদুল ওহাব, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, ড. আবুল আজাদ, বিশ্বজিৎ চৌধুরী।
0 Comments